আগুন ও গার্মেন্টস শিল্প: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভূ-রাজনীতি

  আগুন ও গার্মেন্টস শিল্প: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভূ-রাজনীতি

- অ্যাডভোকেট আবদুর রব পারভেজ রবি

বাংলাদেশের পোশাক শিল্প দেশের অর্থনীতির প্রাণ। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিমানবন্দর, ইপিজেড ও গাজীপুর অঞ্চলে একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। এই আগুন শুধু শ্রমিকের প্রাণ ও পুঁজির ক্ষতি নয়, বরং রাষ্ট্রের রাজনৈতিক, প্রশাসনিক ও ভূ-রাজনৈতিক কাঠামোর দুর্বলতাকেও উন্মোচিত করছে।

আগুন ও গার্মেন্টস শিল্প: বাংলাদেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ও ভূ-রাজনীতি

 শিল্পাঞ্চলে আগুন লাগার ধারাবাহিকতা

গত এক দশকে গাজীপুর, সাভার, নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম ইপিজেড—এমনকি হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরেও বারবার আগুন লাগার ঘটনা ঘটেছে। তদন্ত কমিটি গঠন হলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রকৃত কারণ ও দায় নির্ধারণ হয়নি। অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থার অপ্রতুলতা, ভবনের নকশায় ত্রুটি, শ্রমিক প্রশিক্ষণের অভাব ও বিদ্যুৎবিষয়ক ত্রুটি সাধারণ কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হলেও—ঘটনার পেছনে আরও গভীর রাজনৈতিক ও স্বার্থসংঘাতমূলক বিষয় রয়েছে।

 রাজনৈতিক পটভূমি

বাংলাদেশে শিল্পায়ন দীর্ঘদিন ধরে রাজনৈতিক প্রভাবাধীন। গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠনগুলো সরকারের ঘনিষ্ঠ—ফলে শ্রমিক সুরক্ষার বিষয়টি প্রায়শই উপেক্ষিত হয়। অগ্নিকাণ্ডের পরেও দায়মুক্তি সংস্কৃতি, তদন্তের গোপনীয়তা এবং মিডিয়া নিয়ন্ত্রণ ইঙ্গিত দেয় যে অনেক সময় এই আগুনগুলো কেবল দুর্ঘটনা নয়, বরং রাজনৈতিক বার্তা বা অর্থনৈতিক প্রতিযোগিতার হাতিয়ারও হতে পারে।

 ভূ-রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ

বাংলাদেশের পোশাক শিল্পের বৃহত্তর অংশ যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপ ও চীনা বাজারের সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশ এখন ভারতের, ভিয়েতনামের ও ইন্দোনেশিয়ার বিকল্প। এমন পরিস্থিতিতে শিল্পখাতে অস্থিতিশীলতা সৃষ্টি করে বৈদেশিক বিনিয়োগ নিরুৎসাহিত করার কৌশলও দেখা যায়। অনেক সময় বিদেশি গোয়েন্দা স্বার্থ বা বাণিজ্যচাপের সূত্রেও অগ্নিকাণ্ডকে ‘অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতার বার্তা’ হিসেবে ব্যবহার করা হয়।

 প্রশাসনিক ও নিরাপত্তা দুর্বলতা

ফায়ার সার্ভিস, শিল্প কারখানা পরিদর্শন অধিদপ্তর ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে সমন্বয়ের অভাব এই বিপর্যয় বাড়িয়ে দেয়। বেশিরভাগ কারখানায় ফায়ার লাইসেন্স, এক্সিট পয়েন্ট ও সেফটি ড্রিল নেই। রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে শিল্প নিরাপত্তা ‘প্রচারণার বিষয়’ হলেও বাস্তবে এটি রাজনৈতিক তদবির নির্ভর প্রশাসনিক কাজেই সীমাবদ্ধ।

 শ্রমিক ও সামাজিক প্রভাব

প্রতিটি আগুন শ্রমিক শ্রেণির জীবনে অনিশ্চয়তা বাড়ায়। জীবিকা হারানো, বেকারত্ব, ক্ষতিপূরণহীনতা—এসবের ফলে শ্রমিকদের মধ্যে ক্ষোভ ও হতাশা জন্ম নেয়। কিন্তু সংগঠিত শ্রম আন্দোলনকে রাজনৈতিকভাবে দুর্বল করে রাখায় এই ক্ষোভ কখনও রাজনৈতিক দাবি হিসেবে পরিণত হয় না।


পরিশেষে, বিমানবন্দর ও গার্মেন্টস শিল্পে আগুন কেবল নিরাপত্তাহীনতার প্রতীক নয়, এটি বাংলাদেশের রাজনৈতিক অর্থনীতি ও ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানের একটি প্রতিফলন। এই আগুন নিভাতে হলে শুধু অগ্নিনির্বাপণ নয়—প্রয়োজন রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা, প্রশাসনিক সংস্কার এবং আন্তর্জাতিক স্বার্থের সঠিক ভারসাম্য রক্ষা।

No comments

Powered by Blogger.