গৃহকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি: শ্রম আইন সংশোধন ২০২৫-এর নতুন দিগন্ত

 বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬ সংশোধন ২০২৫-এর মাধ্যমে দেশের শ্রমবাজারে একটি যুগান্তকারী পরিবর্তন এসেছে—শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২ এর উপধারা ৯খ-এ গৃহকর্মী (Domestic Worker) কে আনুষ্ঠানিকভাবে “শ্রমিক” হিসেবে সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

দীর্ঘদিন ধরে দেশের ঘরে ঘরে কর্মরত লক্ষ লক্ষ গৃহকর্মী শ্রমের বাজারে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখলেও তারা শ্রমিকের আইনি পরিচয় ও অধিকার থেকে বঞ্চিত ছিলেন। তাদের কাজ ছিল সমাজের জন্য অপরিহার্য, কিন্তু আইনের পরিধির বাইরে থাকার ফলে ন্যূনতম সুরক্ষা, ন্যায্য মজুরি বা নিরাপত্তা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছিল না।

২০২৫ সালের সংশোধনী এই বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে গৃহকর্মীদের শ্রম অধিকার প্রতিষ্ঠায় নতুন অধ্যায় সূচনা করেছে। ILO Convention 189–এর সুপারিশ অনুযায়ী গৃহস্থালী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন বৈশ্বিক মান। বাংলাদেশ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রসর অবস্থানে এসেছে।

গৃহকর্মীদের শ্রমিক স্বীকৃতি: শ্রম আইন সংশোধন ২০২৫-এর নতুন দিগন্ত


ধারা ২(৯খ)–এ গৃহকর্মী সংজ্ঞার সংযোজন: আইনগত গুরুত্ব

সংশোধনী অনুযায়ী— “শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২(৯খ)-এ গৃহকর্মীকে এমন ব্যক্তি হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে যিনি গৃহস্থালী পরিবেশে মজুরির বিনিময়ে কাজ করেন এবং তিনি শ্রমিক হিসেবে বিবেচিত হবেন।”

এটির অর্থ—

  • গৃহকর্মীরা এখন শ্রমিকের সাংবিধানিক ও আইনি সুরক্ষার আওতায় এলো,
  • শ্রম আইনের অধীনে তাদের অধিকার, দায়িত্ব ও প্রতিকার এখন আইন দ্বারা স্বীকৃত।

এই একক সংযোজন দেশের লক্ষ লক্ষ গৃহকর্মীর জীবনমান, নিরাপত্তা ও মর্যাদায় ব্যাপক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।

গৃহকর্মীকে শ্রমিক হিসেবে স্বীকৃতির ফলে প্রধান পরিবর্তনসমূহ

১. কর্মঘণ্টা ও বিশ্রামের অধিকার নিশ্চিত

আগে গৃহকর্মীদের কাজের সময়সীমা নির্ধারিত ছিল না। এখন—

  • সর্বোচ্চ কর্মঘণ্টা নির্ধারণ করা যাবে,
  • সাপ্তাহিক ছুটি ও দৈনিক বিশ্রামের অধিকার কার্যকর হবে,
  • অতিরিক্ত কাজের ক্ষেত্রে ওভারটাইম সুবিধা প্রযোজ্য হবে।

২. ন্যূনতম মজুরি কাঠামো প্রণয়ন

ধারা ২(৯খ) অনুযায়ী শ্রমিক হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হওয়ায়—

  • ন্যূনতম মজুরি বোর্ড গৃহকর্মীদের জন্য বিশেষ মজুরি কাঠামো নির্ধারণ করতে পারবে,
  • মজুরি আটকে রাখা বা কম মজুরি প্রদান আইনত দণ্ডনীয় অপরাধ হবে।

৩. নিরাপদ কর্মপরিবেশ ও সুরক্ষা

গৃহকর্মী নির্যাতন অপরাধ হিসেবে আরও কঠোরভাবে বিবেচিত হবে। এতে—

  • মানসিক ও শারীরিক নির্যাতনের অভিযোগ শ্রম আদালতে বিচারযোগ্য হবে,
  • নিরাপদ কর্মপরিবেশ নিশ্চিত করতে গৃহস্থদের জন্য আচরণবিধি প্রযোজ্য হবে।

৪. ছুটি, উৎসব ভাতা ও মৌলিক সুবিধা

শ্রমিক হিসেবে গৃহকর্মীরা এখন—

  • বার্ষিক ছুটি,
  • উৎসব ভাতা,
  • চিকিৎসা সহ মৌলিক সুবিধা পাওয়ার আইনি অধিকার অর্জন করেছেন।

৫. নিয়োগপত্র/কর্মচুক্তি বাধ্যতামূলক

গৃহকর্মী ও নিয়োগকর্তার মধ্যে লিখিত বা ডিজিটাল চুক্তি থাকা এখন আইনসম্মত ও প্রয়োজনীয়। এতে—

  • কাজের ধরন,
  • মজুরি,
  • বাসস্থান, খাবার,
  • কর্মঘণ্টা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকবে।

আইনগত বিশ্লেষণ

১. সংজ্ঞা বিস্তৃতি—ন্যায়বিচারের ভিত্তি

শ্রমিক সংজ্ঞায় গৃহকর্মী অন্তর্ভুক্ত হওয়া মানে শ্রমিকের অধিকার থেকে আর কারো বাদ পড়া নয়। ধারা ২(৯খ)-এর মাধ্যমে ঐতিহাসিকভাবে বঞ্চিত একটি বড় শ্রমশক্তি প্রথমবার আইনি পরিচয় পেল।

২. শিশুশ্রম প্রতিরোধে যুগান্তকারী অগ্রগতি

গৃহকর্মী খাত শিশুশ্রমের ঝুঁকিপূর্ণ ক্ষেত্র ছিল। এখন—

  • ১৪ বছরের নিচে কাউকে গৃহকর্মী হিসেবে নিয়োগ সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ,
  • ১৪–১৮ বছরের জন্য নিরাপদ কাজে অংশগ্রহণের বিধান কার্যকর।

৩. শ্রম আদালতে প্রতিকার প্রাপ্তি

আগে গৃহকর্মীদের সমস্যা সমাধান ছিল অনির্দিষ্ট। ধারা ২(৯খ) যুক্ত হওয়ায়—

  • মামলা দায়ের,
  • প্রতিকার পাওয়া,
  • কর্তৃপক্ষের হস্তক্ষেপ সহজ হয়েছে।

সামাজিক প্রভাব

১. সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি

স্বীকৃতি মানে শুধু আইনি পরিবর্তন নয়— এটি একটি মানবিক স্বীকৃতি। গৃহকর্মীদের কাজকে এখন পেশা হিসেবে গণ্য করা হবে—যা তাদের সামাজিক মর্যাদা বাড়াবে।

২. নির্যাতন ও শোষণ কমে যাওয়া

আইনের আওতায় আসায়—

  • জবাবদিহিতা বাড়বে,
  • ভয়ভীতি কমবে,
  • নির্যাতনের ঘটনা কমে আসবে।

৩. কর্মী–নিয়োগকর্তার সম্পর্ক উন্নয়ন

সুস্পষ্ট চুক্তি এবং নির্ধারিত অধিকার–দায়িত্ব সম্পর্ককে স্বচ্ছ, স্থিতিশীল ও দীর্ঘমেয়াদী করবে।

রাষ্ট্রীয় দৃষ্টিকোণ

১. অনানুষ্ঠানিক খাতে শ্রমিকদের অন্তর্ভুক্তি

গৃহকর্মীরা দেশের শ্রমশক্তির গুরুত্বপূর্ণ অংশ। ধারা ২(৯খ) তাদের আনুষ্ঠানিক কাঠামোতে যুক্ত করে রাষ্ট্রের শ্রমনীতিকে আরও শক্তিশালী করেছে।

২. আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সাথে সামঞ্জস্য

ILO Convention 189–এর সুপারিশ অনুযায়ী গৃহস্থালী শ্রমিকের অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করা এখন বৈশ্বিক মান। বাংলাদেশ এই পদক্ষেপের মাধ্যমে আন্তর্জাতিকভাবে অগ্রসর অবস্থানে এসেছে।

উপসংহার

শ্রম আইন ২০০৬-এর ধারা ২(৯খ)-এ গৃহকর্মীদের শ্রমিক হিসেবে সংজ্ঞায় অন্তর্ভুক্তি একটি মানবিক, ন্যায়সংগত ও দূরদর্শী সিদ্ধান্ত। এটি শুধু আইনি পরিবর্তন নয়— গৃহকর্মীদের মর্যাদা, নিরাপত্তা ও অধিকার প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে এটি একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ।

কলামেঃ — আবদুর রব পারভেজ রবি, এডভোকেট ও আইন বিশ্লেষক।

No comments

Powered by Blogger.