ব্যাংক চেক মামলা: হাইকোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ ও আইনগত তাৎপর্য

ব্যাংক চেক মামলা: হাইকোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ ও আইনগত তাৎপর্য

- আবদুর রব পারভেজ রবি, এডভোকেট, বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্ট।

বাংলাদেশে চেক একটি বহুল ব্যবহৃত আর্থিক উপকরণ, বিশেষ করে ব্যবসা-বাণিজ্যে এবং ঋণ-লেনদেনে। দীর্ঘদিন ধরে চেক সংক্রান্ত বিরোধ আদালতে বহুল আলোচিত একটি বিষয়। সম্প্রতি হাইকোর্ট একটি আলোচিত মামলায় গুরুত্বপূর্ণ পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন, যেখানে বলা হয়েছে—Name, Amount এবং Date উল্লেখ ব্যতীত কোন ব্যাংক চেক আইনগত দৃষ্টিকোণ থেকে ‘Cheque’ হিসেবে গণ্য নয়। অতএব, Blank Cheque প্রদানকারী পরবর্তীতে উল্লেখিত অর্থ পরিশোধে বাধ্য থাকবেন না।

আদালতের পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, প্রাপকের নাম, টাকার অঙ্ক ও তারিখ ছাড়া কোনো চেক আইনের চোখে বৈধ নয়। এ ছাড়া, ব্ল্যাঙ্ক (ফাঁকা) চেক প্রদান করলেও দাতা অর্থ প্রদানে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবেন না। এই রায়ের ফলে দীর্ঘদিন ধরে Blank Cheque-কে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠা মামলা ও ব্যবসায়িক প্রথার উপর নতুন করে প্রশ্ন উঠেছে।

ব্যাংক চেক মামলা: হাইকোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণ ও আইনগত তাৎপর্য

এই পর্যবেক্ষণ আইনজীবী ও ব্যবসায়ী মহলে আলোচনার জন্ম দিয়েছে, বিশেষত কারণ এটি সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী কিছু সিদ্ধান্তের সাথে সরাসরি সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়।

মামলার পটভূমি
অভিযোগকারী সাইফুল ইসলাম দাবি করেন—

  • ২০১৯ সালের আগস্টে আসামি মান্নান তার কাছ থেকে ৪৮ লাখ টাকা ঋণ নেন।
  • টাকা ফেরত না দেওয়ায় ২০২০ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি আসামি একটি চেক প্রদান করেন।
  • তবে ব্যাংকে উপস্থাপন করলে চেকটি “Insufficient Funds” মন্তব্যসহ ফেরত আসে।
  • অন্যদিকে আসামি মান্নান জানান—
  • তিনি ব্যবসায়িক লেনদেনের নিরাপত্তার জন্য কিছু Blank Cheque প্রদান করেছিলেন।
  • অভিযোগকারী ও তার পিতা পুরোনো চেক ব্যবহার করে মামলা করেছেন

ট্রায়াল কোর্টের রায় (২৩ মে ২০২৪)

  • অভিযোগকারী ৪৮ লাখ টাকার উৎস প্রমাণ করতে ব্যর্থ হন।
  • চেকের লেখার অংশে ভিন্ন হস্তাক্ষর পাওয়া যায়।
  • আসামি শুধু স্বাক্ষর করেছিলেন, কিন্তু বাকি তথ্য কে লিখেছে তা প্রমাণিত হয়নি।
  •      ফলাফল: ট্রায়াল কোর্ট আসামিকে খালাস দেন।

হাইকোর্টের পর্যবেক্ষণ (১৯ মে ২০২৫)
হাইকোর্ট ট্রায়াল কোর্টের রায় বহাল রেখে গুরুত্বপূর্ণ কিছু নীতি নির্ধারণ করেন:

  • অভিযোগকারী কোনো বৈধ প্রমাণ হাজির করতে পারেননি।
  • প্রাপকের নাম, অর্থের পরিমাণ ও তারিখ ছাড়া কোনো চেক বৈধ নয়।
  • “Undated cheque” বা “Blank cheque” ব্যাংকে উপস্থাপনযোগ্য নয়।
  • খালি চেক প্রদান করে আসামিকে অর্থ পরিশোধে বাধ্য করার আইনগত সুযোগ নেই।
  • মামলার চেকটি পুরোনো ও পুনঃব্যবহৃত।

পূর্ববর্তী নজিরের উল্লেখ
আদালত A.H. Ershadul Haque vs State, 75 DLR (2023) 447 মামলার দৃষ্টান্ত টেনে আনেন, যেখানে বলা হয়েছিল:

  • চেক প্রদানের ৬ মাসের মধ্যে তা উপস্থাপন করতে হবে।
  • Undated বা Blank Cheque আইনসঙ্গত নয়।

চূড়ান্ত রায়

  • হাইকোর্ট ট্রায়াল কোর্টের খালাসাদেশ বহাল রাখেন।
  • অভিযোগকারীকে ৫,০০০ টাকা জরিমানা দিতে নির্দেশ দেন, যা ৩০ দিনের মধ্যে ট্রায়াল কোর্টে জমা দিতে হবে।

বিশ্লেষণ ও তাৎপর্য
১. আইনগত স্পষ্টীকরণ: এই রায় পরিষ্কারভাবে জানিয়ে দিল যে Blank Cheque বৈধ নয় এবং এ ধরনের চেক দিয়ে মামলা করার সুযোগ সীমিত।
২. Debtor-এর স্বস্তি: যারা নিরাপত্তার জন্য Blank Cheque দিয়েছেন, তাদের জন্য এটি একটি বড় আইনি সুরক্ষা।
৩. Creditor-এর ঝুঁকি: পাওনাদাররা যদি কেবল Blank Cheque-এর উপর নির্ভর করেন, তবে তা আর অর্থ আদায়ের কার্যকর উপায় নাও হতে পারে।
৪. ব্যবসায়িক বাস্তবতা: বাংলাদেশে লেনদেন সুরক্ষায় Blank Cheque দেওয়ার প্রথা প্রচলিত। এই রায় সেই প্রথার ওপর বড় ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে।
৫. ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তা: সুপ্রিম কোর্টের পূর্ববর্তী কিছু সিদ্ধান্তের সাথে এই রায় সাংঘর্ষিক। তাই আপিল বিভাগ ভবিষ্যতে এ বিষয়ে কী পর্যবেক্ষণ দেন তা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হবে।

চেক প্রতারণা সংক্রান্ত মামলায় হাইকোর্টের এই রায় বাংলাদেশের আর্থিক আইন ও ব্যাংকিং প্রক্রিয়ার জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মাইলফলক। Blank Cheque আর শুধুমাত্র দায়বদ্ধতার প্রমাণ হিসেবে গণ্য হবে না—এটি আদালতের একটি কঠোর আইনি ব্যাখ্যা। তবে সুপ্রিম কোর্টের ভবিষ্যৎ সিদ্ধান্তের ওপর নির্ভর করছে এই নীতি চূড়ান্তভাবে প্রতিষ্ঠিত হবে কি না।

No comments

Powered by Blogger.