“সরকার ঘোষিত কারাগার: আইনি ভিত্তি, প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক নজির”

 সাম্প্রতিক মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে করা তিন মামলায় গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির পর যে ১৫ কর্মকর্তাকে হেফাজতে নেওয়া হয়েছে, তাঁদের বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেনাবাহিনী নিজেদের হেফাজতে রাখতে চায়। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল তিন মামলায় গত বুধবার সেনাবাহিনীর ২৫ জনের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করেছেন।

“সরকার ঘোষিত কারাগার: আইনি ভিত্তি, প্রেক্ষাপট ও ঐতিহাসিক নজির”


আটক ব্যক্তির আইনগত অধিকার

সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৩৩(২) অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলে তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে, অন্যথায় তা বেআইনি আটক হিসেবে গণ্য হবে। ফৌজদারি কার্যবিধি, ১৮৯৮ (CrPC), ধারা ৬১:পুলিশ কোনো আসামিকে গ্রেপ্তার করার পর ২৪ ঘণ্টার বেশি আদালতের আদেশ ছাড়া আটক রাখতে পারে না।

আটক পরবর্তী আদালতের ভূমিকা

আদালত আসামিকে হাজির করার পর নিম্নোক্ত সিদ্ধান্ত দিতে পারেন—

  • কারাগারে পাঠানো (Judicial Custody)
  • পুলিশ রিমান্ডে প্রদান (Police Custody)
  • জামিনে মুক্তি (Bail)

এটি আদালতের বিচারবিবেচনার ওপর নির্ভর করে, মামলার ধরণ ও অপরাধের গুরুতরতার প্রেক্ষিতে।

কারাগার কি ও এর উৎপত্তি

কারাগার হলো এমন একটি স্থান, যেখানে অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নির্দেশে আটক রাখা হয়। এটি সমাজে শৃঙ্খলা ও বিচারব্যবস্থা রক্ষার একটি অংশ। “Prisons Act, 1894” (কারা আইন, ১৮৯৪)–এর ধারা ৩ অনুযায়ী, ‘Prison’ বলতে বোঝায় যে কোনো স্থান, যেটিকে সরকার কারাগার হিসেবে ঘোষণা করেছে, এবং যেখানে অপরাধে দণ্ডপ্রাপ্ত বা বিচারাধীন ব্যক্তিকে আইন অনুযায়ী আটক রাখা হয়। কারাগার হলো এমন একটি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, যেখানে আদালতের আদেশে অপরাধে অভিযুক্ত বা দণ্ডপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে নিরাপদে আটক রাখা হয়, এবং সংশোধন ও পুনর্বাসনের সুযোগ প্রদান করা হয়।

কারাগারব্যবস্থা ব্রিটিশ আমলে “Prisons Act, 1894”–এর মাধ্যমে গঠন করা হয়।বর্তমানে বাংলাদেশে প্রতিটি কারাগার স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অধীনে পরিচালিত হয়,এবং “কারা অধিদপ্তর” (Department of Prisons) এই ব্যবস্থাপনার দায়িত্বে আছে।

বাংলাদেশে কোনো ব্যক্তি গ্রেপ্তারের পর তাকে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হয়—এটি সংবিধান ও ফৌজদারি কার্যবিধির অন্যতম মৌলিক শর্ত। আদালত তখন সিদ্ধান্ত নেন আসামিকে কারাগারে পাঠানো হবে নাকি জামিন দেওয়া হবে। তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার নিজ ক্ষমতাবলে কোনো স্থাপনাকে কারাগার বা উপকারাগার (সাবজেল) হিসেবে ঘোষণা করতে পারে। এ ধরনের ঘোষণা প্রশাসনিক হলেও, আসামিকে সেখানে রাখার সিদ্ধান্ত সম্পূর্ণ আদালতের এখতিয়ারভুক্ত।

কারাগার ঘোষণার আইনি ভিত্তি

বাংলাদেশের কারা আইন, ১৮৯৪ (Prisons Act, 1894) এর ধারা ৩–এ সরকারকে এই ক্ষমতা প্রদান করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, সরকার “any place”—অর্থাৎ যেকোনো স্থান—কারাগার হিসেবে ঘোষণা করতে পারে, এবং এমন ঘোষণা সরকারি গেজেটে প্রকাশ করতে হয়।

এই আইনি বিধানের ফলে সরকার কোনো স্থাপনাকে অস্থায়ী বা স্থায়ীভাবে কারাগার ঘোষণা করতে পারে, যেমন—

  • সরকারি ভবন
  • হাসপাতাল
  • আবাসিক বাড়ি
  • প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা সরকারি কোয়ার্টার ইত্যাদি।

কারাগার ঘোষণা পরবর্তী আদালতের ভূমিকা

যদিও সরকার কোনো স্থাপনাকে কারাগার ঘোষণা করতে পারে, কিন্তু কোনো নির্দিষ্ট আসামিকে সেখানে রাখা হবে কিনা তা আদালত নির্ধারণ করেন। আদালত চাইলে—

  • নিয়মিত জেলা বা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠাতে পারেন, অথবা
  • পরিস্থিতি অনুযায়ী ঘোষিত উপকারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দিতে পারেন।

এভাবে প্রশাসনিক ক্ষমতা ও বিচারিক কর্তৃত্বের মধ্যে একটি ভারসাম্য রক্ষা করা হয়।

সাবজেল বা উপকারাগারের ধারণা

সাবজেল (Sub-jail)” বা “উপকারাগার” বলতে বোঝায় এমন স্থান, যা সরকার অস্থায়ীভাবে কারাগার হিসেবে ঘোষণা করে। এ ধরনের কারাগারে সাধারণত বিশেষ নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য বা রাজনৈতিক বিবেচনায় উচ্চপ্রোফাইল আসামিদের রাখা হয়।

ঐতিহাসিক নজির

বাংলাদেশে সাবজেল ঘোষণার সবচেয়ে আলোচিত নজিরটি দেখা যায় ২০০৭–০৮ সালের এক-এগারো সময়কালে। তখন সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে—

  • আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা, এবং
  • বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া গ্রেপ্তার হওয়ার পর সংসদ ভবন এলাকায় দুটি সরকারি বাড়িকে সাবজেল ঘোষণা করা হয়
  • সেনানিবাসের একটি ভবন ইতিমধ‌্যে কারাগার ঘোষণা করেছেন আন্তজার্তিক অপরাধ ট্রাইব‌্যুনাল।

দুই নেত্রীকেই ঐ ঘোষিত উপকারাগারগুলোতে দীর্ঘ সময় রাখা হয়েছিল। এটি বাংলাদেশের ইতিহাসে সরকার ঘোষিত কারাগারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত।

পরিশেষে, সরকার ঘোষিত কারাগার ব্যবস্থা মূলত প্রশাসনিক নিরাপত্তা ও বিশেষ পরিস্থিতি ব্যবস্থাপনার একটি হাতিয়ার। তবে এর প্রয়োগে স্বচ্ছতা, ন্যায়বিচার ও মানবাধিকারের সুরক্ষা নিশ্চিত করা জরুরি, যাতে এই ক্ষমতার অপব্যবহার না ঘটে। আইনের মূল উদ্দেশ্য হলো ন্যায্য প্রক্রিয়ার মাধ্যমে বিচারপ্রার্থীর অধিকার রক্ষা করা, প্রশাসনিক নিয়ন্ত্রণ নয়।

সর্বপরি, বাংলাদেশের আইনি কাঠামো সরকারকে কারাগার ঘোষণা করার বিশেষ ক্ষমতা দিয়েছে, তবে এর বাস্তব প্রয়োগ সর্বদা আদালতের তত্ত্বাবধানে ও আইনানুগ প্রক্রিয়ায় হতে হবে।রাষ্ট্রের নিরাপত্তা ও মানবাধিকারের ভারসাম্য রক্ষা করেই এই আইনটি প্রণীত, যা গণতান্ত্রিক প্রশাসনব্যবস্থার একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক।

No comments

Powered by Blogger.