ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ: বাংলাদেশ ও আন্তর্জা‌তিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা, সংকট ও উত্তরণের পথ।

সমকালীন রাজনীতিতে ফ্যাসিবাদআধিপত্যবাদ এই দুটি ধারণা আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার রাষ্ট্রগুলোতে ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ, বিরোধী কণ্ঠ দমন, মতপ্রকাশের সংকোচন এবং বড় রাষ্ট্রের প্রভাব বিস্তারের প্রবণতা এই আলোচনাকে অনিবার্য করেছে। ২০২৪ পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এবং বাংলাদেশ–ভারত সম্পর্কের টানাপোড়া এই দুটি ধারণাকে নতুন করে বিশ্লেষণের দাবি রাখে।

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ: বাংলাদেশ ও আন্তর্জা‌তিক প্রেক্ষাপটে ক্ষমতা, সংকট ও উত্তরণের পথ।


১. ফ্যাসিবাদ কী?

ফ্যাসিবাদ একটি রাজনৈতিক মতাদর্শ ও শাসনপ্রণালি, যার প্রধান বৈশিষ্ট্যগুলো হলো—

  • রাষ্ট্রক্ষমতার অতিমাত্রায় কেন্দ্রীকরণ
  • একক ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর কর্তৃত্ব
  • বিরোধী মত ও রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দমন
  • গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানকে দুর্বল বা অকার্যকর করা
  • আইন, প্রশাসন ও নিরাপত্তা বাহিনীকে ক্ষমতা রক্ষার হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার

সহজভাবে বলা যায়, যেখানে রাষ্ট্র জনগণের জন্য নয়, জনগণ রাষ্ট্রের জন্য বাধ্যতামূলক আনুগত্যে আবদ্ধ সেখানেই ফ্যাসিবাদের বীজ জন্ম নেয়।

২. আধিপত্যবাদ কী?

আধিপত্যবাদ (Hegemonism) মূলত আন্তর্জাতিক রাজনীতির একটি ধারণা, যেখানে—

  • একটি শক্তিশালী রাষ্ট্র দুর্বল রাষ্ট্রের ওপর

আধিপত্যবাদ সবসময় সামরিক আগ্রাসনের মাধ্যমে আসে না; অনেক সময় এটি আসে চুক্তি, নির্ভরশীলতা, ভিসা–বাণিজ্য–ট্রানজিট, নিরাপত্তা ও কূটনৈতিক চাপের মাধ্যমে

৩. বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদের উপস্থিতি: কিভাবে ও কার হাতে

বাংলাদেশে ফ্যাসিবাদ কোনো একক দিনে সৃষ্টি হয়নি; এটি ধাপে ধাপে বিকশিত হয়েছে। লক্ষণগুলো হলো-

(ক) রাজনৈতিক ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ

  • নির্বাহী বিভাগ অত্যন্ত শক্তিশালী
  • সংসদ ও বিচার বিভাগের কার্যকর ভারসাম্য প্রশ্নবিদ্ধ
  • নির্বাচন ব্যবস্থা নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে আস্থার সংকট

(খ) মতপ্রকাশ ও বিরোধী কণ্ঠ দমন

  1. রাজনৈতিক আন্দোলন, প্রতিবাদ ও ভিন্নমতকে রাষ্ট্রীয় শক্তি দিয়ে দমন

  1. ডিজিটাল আইন ও নিরাপত্তা আইন ব্যবহার করে ভয়ের পরিবেশ সৃষ্টি

(গ) রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর রাজনৈতিককরণ

  • প্রশাসন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থাগুলো ক্ষমতাসীন গোষ্ঠীর প্রতি অনুগত হয়ে ওঠা
  • আইনের শাসনের পরিবর্তে ক্ষমতার শাসন প্রতিষ্ঠা

👉 এই প্রক্রিয়ায় রাষ্ট্রীয় ক্ষমতাধর গোষ্ঠী ও তাদের সহযোগী রাজনৈতিক–অর্থনৈতিক এলিটরা ফ্যাসিবাদী কাঠামোর প্রধান ধারক হয়ে ওঠে।

৪. বাংলাদেশে আধিপত্যবাদ: অভ্যন্তরীণ ও বহির্মুখী বাস্তবতা

(ক) ভারতের ভূমিকা ও আঞ্চলিক আধিপত্য

দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত একটি প্রভাবশালী রাষ্ট্র। বাংলাদেশের ক্ষেত্রে-

  • অসম শক্তির কূটনৈতিক সম্পর্ক
  • ট্রানজিট, বিদ্যুৎ, পানি, বাণিজ্য ও নিরাপত্তা ইস্যুতে নির্ভরশীলতা
  • ভিসা, সীমান্ত ও কূটনৈতিক চাপ

এই বাস্তবতা অনেক সময় বাংলাদেশকে স্বাধীন পররাষ্ট্রনীতির পরিবর্তে প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে ঠেলে দেয়।

(খ) অভ্যন্তরীণ আধিপত্য

  • অর্থনৈতিক ক্ষমতা কিছু কর্পোরেট ও রাজনৈতিক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত
  • সাধারণ জনগণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন

ফলে আধিপত্যবাদ শুধু বাহ্যিক নয়, দেশের ভেতরেও একটি শ্রেণিগত আধিপত্যে রূপ নেয়

৫. বর্তমান পরিস্থিতি ও প্রভাব

(ক) রাজনৈতিক প্রভাব

  • গণতান্ত্রিক চর্চা দুর্বল
  • রাজনৈতিক সহিংসতা ও অবিশ্বাস বৃদ্ধি

(খ) সামাজিক প্রভাব

  • নাগরিকদের মধ্যে ভয় ও আত্মনিয়ন্ত্রণ (self-censorship)
  • তরুণ সমাজের রাজনৈতিক বিমুখতা বা চরমপন্থায় ঝুঁকে পড়া

(গ) আন্তর্জাতিক প্রভাব

  • মানবাধিকার ইস্যুতে আন্তর্জাতিক চাপ
  • কূটনৈতিক সম্পর্কের অস্থিরতা
  • অর্থনৈতিক ও বিনিয়োগ ঝুঁকি বৃদ্ধি

৬. উত্তরণের পথ: ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ থেকে মুক্তির কৌশল

(ক) অভ্যন্তরীণ উত্তরণ

  1. আইনের শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা
  2. স্বাধীন নির্বাচন ব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ
  3. বিচার বিভাগের প্রকৃত স্বাধীনতা
  4. মতপ্রকাশ ও রাজনৈতিক অধিকার সুরক্ষা
  5. রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে দলীয় প্রভাবমুক্ত করা

(খ) পররাষ্ট্রনীতিতে ভারসাম্য

  1. সমতা ও পারস্পরিক স্বার্থভিত্তিক কূটনীতি
  2. একক রাষ্ট্রনির্ভরতা পরিহার করে বহুমুখী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক
  3. আন্তর্জাতিক আইন ও সার্বভৌমত্বের নীতিতে অটল থাকা

(গ) নাগরিক ও সামাজিক ভূমিকা

  • সচেতন নাগরিক সমাজ
  • শক্তিশালী গণমাধ্যম
  • আইনভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক আন্দোলন

উপসংহার

ফ্যাসিবাদ ও আধিপত্যবাদ কখনো হঠাৎ আসে না এগুলো ধীরে ধীরে সমাজের ভেতরে শিকড় গড়ে তোলে। বাংলাদেশ আজ এমন এক সন্ধিক্ষণে দাঁড়িয়ে, যেখানে গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ব, সার্বভৌমত্ব বনাম নির্ভরশীলতা এই দ্বন্দ্ব স্পষ্ট। এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের একমাত্র পথ হলো গণতান্ত্রিক পুনর্জাগরণ, আইনের শাসন ও ভারসাম্যপূর্ণ আন্তর্জাতিক সম্পর্ক। অন্যথায় রাষ্ট্র শক্তিশালী হলেও নাগরিক দুর্বলই থেকে যাবে।

No comments

Powered by Blogger.